Hot Posts

6/recent/ticker-posts

ড. মুহাম্মদ ইউনূস

 ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস একজন খ্যাতিমান বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ এবং উদ্যোক্তা, যিনি বিশ্বজুড়ে "গ্রামীণ ব্যাংক" প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ ধারণা প্রচলন করেছেন। তাঁর এই উদ্যোগ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছে। এজন্য তিনি ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস


 শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা

মুহাম্মদ ইউনুসের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামে। তাঁর পিতা হাজী দুলা মিয়া একজন সফল স্বর্ণকার ছিলেন, এবং মা সাফিয়া খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী। তিনি পরিবারের তৃতীয় সন্তান ছিলেন। পরিবারে শিক্ষার গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত বেশি, তাই ছোটবেলা থেকেই তিনি শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহী ছিলেন।


উচ্চ শিক্ষা ও শিক্ষাজীবন

ইউনুস চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর, তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পান। সেখানে তিনি উন্নয়ন অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন।

কর্মজীবন ও শিক্ষকতা

পিএইচডি অর্জনের পর, ড. ইউনুস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে দেশপ্রেমিক ইউনুস নিজের দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ছাত্রদের মধ্যে উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলতেন এবং তাঁদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন।


গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় ড. ইউনুস চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে ভ্রমণ করেছিলেন, যেখানে তিনি গ্রামের মানুষের দারিদ্র্যের প্রকৃত চিত্র দেখতে পান। এই দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক সহায়তা পেলে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে পারে। সেই চিন্তা থেকে তিনি ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।


গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে, যেখানে কোন জামানত বা উচ্চ সুদের প্রয়োজন হয় না। এই ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, এবং এটি নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রামীণ ব্যাংক দারিদ্র্য বিমোচন এবং নারীর ক্ষমতায়নে অনন্য অবদান রাখে। ইউনুসের এই ধারণা সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে এবং তা দারিদ্র্য বিমোচনের একটি কার্যকর মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

 আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও নোবেল পুরস্কার

ড. ইউনুসের ক্ষুদ্রঋণ উদ্যোগ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়। তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৬ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক এই পুরস্কারটি যৌথভাবে পান। এর আগে ও পরে তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তাঁর কাজের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, দারিদ্র্য শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক সমস্যা, যা সমাধানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি।

লেখালেখি ও ভাবনা

ড. ইউনুস একজন উঁচুমানের চিন্তাবিদ এবং লেখক। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা এবং চিন্তাধারা নিয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো "ব্যাঙ্কার টু দ্য পুওর", "ক্রিয়েটিং আ ওয়ার্ল্ড উইদাউট পভার্টি", এবং "বিল্ডিং সোশ্যাল বিজনেস"। এসব গ্রন্থে তিনি তাঁর ক্ষুদ্রঋণ ধারণা, সামাজিক ব্যবসা এবং দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, মানবতার উন্নয়নে ব্যবসায়িক উদ্যোগ হতে পারে একটি কার্যকর মাধ্যম।


সামাজিক ব্যবসা

ড. ইউনুসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হলো "সামাজিক ব্যবসা" বা "সোশ্যাল বিজনেস" ধারণা প্রচলন। এটি এমন একটি ব্যবসায়িক মডেল, যেখানে লাভের উদ্দেশ্য নয় বরং সামাজিক সমস্যার সমাধান করাই মুখ্য লক্ষ্য। এ মডেলের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের বাইরে গিয়ে সমাজের কল্যাণে কাজ করতে পারে। এই ধারণা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান এটি অনুসরণ করছে।

ড. ইউনুসের সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জ

ড. ইউনুসের অর্জন এবং অবদান অনেক, কিন্তু তাঁকে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে। বাংলাদেশে কিছু মহল তাঁর ক্ষুদ্রঋণ মডেল এবং গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাঁকে নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে ব্যাংকের পরিচালনা নিয়ে সরকারের সাথে বিরোধের কারণে। ২০১১ সালে তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, যা আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হয়। তবে এসব সমালোচনা তাঁর অবদানের মূল্য কমাতে পারেনি।


 ব্যক্তিগত জীবন

ড. ইউনুসের ব্যক্তিগত জীবনও অনুপ্রেরণার একটি দৃষ্টান্ত। তিনি দুইবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রথম স্ত্রী বীণাপাণি, যিনি একজন প্রবাসী বাঙালি ছিলেন। তাঁদের সংসারে একটি মেয়ে রয়েছে, যার নাম মনিকা ইউনুস। প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পর তিনি আফরোজী ইউনুসকে বিয়ে করেন।


বর্তমান কাজ ও ভাবনা

ড. ইউনুস বর্তমানে "ইউনুস সেন্টার" এর মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন। তিনি সামাজিক ব্যবসা ধারণাকে আরও বিস্তৃত করার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর বিশ্বাস, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং পরিবেশগত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।


উপসংহার

ড. মুহাম্মদ ইউনুস একজন অনন্য অর্থনীতিবিদ, উদ্যোক্তা এবং মানবাধিকার কর্মী। তাঁর ক্ষুদ্রঋণ ধারণা এবং সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর কাজের জন্য তিনি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত এবং নোবেল শান্তি পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা লাভ করেছেন। তাঁর জীবন এবং কাজ প্রমাণ করে যে, একটি ধারণা ও উদ্যোগ কিভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন পরিবর্তন করতে পারে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ